মুফতি মোহাম্মদ এনামুল হাসান >>
যেসব সৌভাগ্যবান সাহাবি সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, আবুবকর সিদ্দিক (রা.) তাদের মধ্যে অন্যতম। আবুবকর (রা.)-এর ইসলামগ্রহণ সম্পর্কে নবী (সা.) নিজে বলেন, ‘আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, তার মধ্যেই একপ্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব অবস্থা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু যখন আবুবকরের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছি, তিনি কোনোরূপ সংকোচ না করে তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন নবীজির বিপদাপদের সাথি।
বিশ্বনবী (সা.)-এর পরে উম্মতের মধ্যে আবুবকর সিদ্দিক (রা.) হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। প্রথমে তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের সাহায্যার্থে সবকিছু খরচ করতে করতে এমন অবস্থায় উপনীত হন, নবী (সা.) একবার সাহাবিদের কাছ থেকে অনুদান আদায়ের সময় আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ঘরে যা ছিল সম্পূর্ণ এনে রাসুলের সামনে পেশ করলেন। নবী (সা.) বললেন, আবুবকর! ঘরে কী রেখে এসেছেন? উত্তরে বললেন, আল্লাহ এবং তার রাসুলকে। অর্থাৎ ঘরে যা ছিল তাই নিয়ে এসেছেন।
ইসলামের জন্য আবুবকর (রা.)-এর ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল সীমাহীন। নবী (সা.) বলেন, ‘আমার ওপর যার যত এহসান ছিল প্রত্যেকের প্রতিদানই আমি দিয়ে দিয়েছি কিন্তু আবুবকরের প্রতিদান বাকি রয়ে গেছে। আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন নিজ হাতে আমার আবুবকরের প্রতিদান দান করবেন।’
নবী (সা.)-এর ওফাতের পর যখন মুসলমানদের আবুবকরকে খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) নিযুক্ত করা হলো, তখন ভোরে কিছু কাপড় নিয়ে বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে যেতে উদ্যত হলেন, উমর (রা.) তা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে তিনি বললেন, আমাকে তো রাষ্ট্রপ্রধান করে মুসলমানদের কাজে নিযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমার পরিবার-পরিজন রয়েছে, তাদের খানাপিনার ব্যবস্থাও তো করতে হবে। তাই বাজারে যাচ্ছি কাপড় বিক্রি করতে।
আবু উবায়দা (রা.) ছিলেন রাষ্ট্রের কোষাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত। উমর (রা.) বললেন, ‘আসুন আমরা তার কাছে যাই। তিনি আপনার জন্য কিছু ভাতা ঠিক করে দেবেন।’ আবু উবায়দা (রা.) বললেন, একজন সাধারণ মুহাজির সাহাবির ভাতা যে পরিমাণ, আপনাকেও তাই দেওয়া হবে। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, যে পরিমাণ ভাতা আবুবকর (রা.)-এর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা দিয়ে তার সংসার পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ না করে তিনি সাধারণভাবেই জীবনযাপন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে তিনি সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করতেন। একবার আবুবকর সিদ্দিক (রা.)-এর স্ত্রী উম্মে রুমান (রা.) তার স্বামীকে বললেন, বাচ্চাদের মিষ্টান্ন খেতে মন চাচ্ছে। রাষ্ট্রপ্রধান স্বামী উত্তর দিলেন, আমার কাছে তো এত পয়সা নেই, যা দিয়ে তোমাদের জন্য মিষ্টান্ন কিনে খাওয়াতে পারি।
স্ত্রী বললেন, আমরা যদি দৈনিক খরচ থেকে সামান্য সামান্য বাঁচিয়ে রাখি, তাহলে তা দিয়ে মিষ্টান্ন কিনে আনতে পারব। কিছুদিন পর কিছু পয়সা বাঁচিয়ে স্বামীর হাতে দিলেন মিষ্টান্ন আনার জন্য। কিন্তু আবুবকর (রা.) বললেন, তুমি যেহেতু এই পরিমাণ পয়সা বাঁচিয়ে রাখতে পারলে, তাহলে বোঝা গেল এই পরিমাণ পয়সা ছাড়াও আমার সংসার চলতে পারে। স্ত্রীর কাছ থেকে পয়সাগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দিকে গেলেন এবং তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে বললেন, আগামী মাস থেকে আমার ভাতা এই পরিমাণ কমিয়ে দেবে। কারণ এই পয়সা ছাড়াও আমার সংসার চলতে পারে।
ইন্তেকালের আগে আবুবকর সিদ্দিক (রা.) তার কন্যা আয়েশা (রা.)-কে বললেন, আমি রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার সুবাদে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমাকে দুধদাত্রী একটি উটনী, তরকারির পেয়ালা এবং এই চাদরটি দেওয়া হয়েছিল। আমার ইন্তেকালের পর উমর (রা.)-এর কাছে ওই জিনিসগুলো পৌঁছে দেবে।
ভেবে দেখুন— একজন রাষ্ট্রপ্রধান আবু বকর (রা.) রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহারে কী পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক। আজও বিশ্বজুড়ে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাদের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান আবুবকর সিদ্দিক (রা.) হলেন রোলমডেল।