খেলাফত মজলিস নেতার উপর হাসিনা সরকারের নি র্যা ত ন

  • হাতকড়া পরিয়ে রিমান্ডে অকথ্য গালাগাল
  • যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয়নি অন্তঃসত্বা স্ত্রীর সঙ্গে

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

পতিত আওয়ামী সরকারের চরম নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিবের দায়িত্বে থাকা এই নেতাকে দীর্ঘ ১৮ মাস জেলে কাটাতে হয়েছে।

কয়েক দফায় ৩৯টি বানোয়াট মামলায় জড়ানো হয় তাকে। একটানা ১৭ দিনসহ মোট ২৮ দিন রিমান্ডের নামে পুলিশি হয়রানি, নির্যাতন ও গালাগালের শিকার হয়েছেন এই আলেম। জেলে থাকাবস্থায় তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীও স্বামীর অনুপস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েন। বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকেও।

এসব জুলুম-নির্যাতন প্রসঙ্গে মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আমলে আলেম-ওলামাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করা হয়েছে। ব্যাপকভাবে তাদের ধরপাকড় করা হয়েছে। এমনকি অনেককে বিচারের নামে ফাঁসিতেও ঝোলানো হয়েছে। ২০২১ সালে রাজধানীর দোলাইরপাড়ে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য স্থাপনের প্রতিবাদ করায় এ দেশের ওলামায়ে কেরামের ওপর সরকারের কুদৃষ্টি পড়ে।

তারপর থেকে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র করে আলেমদের নির্যাতন করার পরিকল্পনা করা হয়। তিনি বলেন, সরকারের এসব জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় থাকায় আমাকেও খোঁজা শুরু করে পুলিশ। মাওলানা মামুনুল হক যখন গ্রেপ্তার হন, তার আগে থেকেই তার সঙ্গে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসায় ছিলাম। তাকে গ্রেপ্তারের পরও সেখানে ছিলাম আমি। এটা হয়তো পুলিশের গোয়েন্দা সদস্যরা টের পেয়েছিলেন। একপর্যায়ে এপ্রিলের ২০ তারিখে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আতাউল্লাহ আমীন বলেন, রোজার মাসে সেদিন তারাবি পড়ে জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসার মেহমানখানায় বসেছিলাম। এমন সময় নিচে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আনাগোনা দেখতে পাই। এর মধ্যে র‌্যাব-২-এর একজন অফিসার মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে এসে বলেন, আতাউল্লাহ আমীন আছেন কি না, তাকে তুলে দিতে হবে। একপর্যায়ে রাত ১২টার দিকে আমি সাক্ষাৎ করে কাপড়চোপড় নিয়ে তাদের সঙ্গে যাই।

২০১৩ সালে হেফাজতের ঘটনায় তিন থানায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগসহ ২৫টির মতো মামলার এজাহারে মাওলানা আতাউল্লাহর নাম ছিল। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বায়তুল মোকাররমে একটি কর্মসূচিকে ঘিরে ব্যাপক নির্যাতন চালায় পুলিশ।

ওই ঘটনায় ১০টি মামলায় বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে তাকেও জড়ানো হয়। ২০২১ সালের মোদিবিরোধী আন্দোলনের সময়কার মামলায়ও তার নাম আছে। এ জন্য মানসিকভাবে গ্রেপ্তারের জন্য প্রস্তুত ছিলেন তিনি। দুই বছরে ৩৯টি মামলা দেওয়া হয় এই আলেমের বিরুদ্ধে।

২০ তারিখে গ্রেপ্তার করেই প্রথম র‌্যাব-২-এ নিয়ে যাওয়া হয় আতাউল্লাহ আমীনকে। সেখান থেকে র‌্যাবের প্রধান কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি বিকালে পল্টন থানার একটি মামলায় তাকে হস্তান্তর করা হয়।

পরের দিন পল্টন থানা থেকে সন্ত্রাসবিরোধী ধারার একটি মামলায় কোর্টে উঠিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এরপর পল্টন থানায় আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে মতিঝিল, শাহবাগ ও রমনায় একটি করে মামলা মিলে পাঁচ মামলায় প্রথম দফায় একটানা ১৭ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয় তরুণ এই আলেমকে। আরও দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখালেও তাতে রিমান্ড হয়নি। সাতটি মামলা মাথায় নিয়ে ১৮ মাস এক দিন জেলে কাটাতে হয়।

১৭ দিনের রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরে মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, প্রথমে পল্টন থানার আট দিন রিমান্ডে আমরা একসঙ্গে প্রায় ১০ জন ছিলাম। ওই থানার তৎকালীন ওসি অনেকটা দায়িত্বশীল হওয়ার কারণে সেখানে তেমন কষ্ট হয়নি। বাইরে থেকে কিছু খাবার নেওয়ারও সুযোগ দিত না। পল্টন থেকে নেওয়া হয় মতিঝিল থানার তিন দিনের রিমান্ডে। সেখানে খুব কড়াকড়ি ছিল। ওসি আমাকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

কিছু ধমক ছাড়া তিনিও তেমন খারাপ ব্যবহার করেননি। তবে রমনা থানায় তিন দিনের রিমান্ডে অনেক কষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের এই নেতা। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারে আমাকে সেখানে নেওয়া হয়। পরদিন জুমার নামাজের পর ওসি মনির মিয়া আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন। সেখানে সরকারদলীয় কিছু লোকজনও ছিলেন।

থানার মধ্যেই হাতকড়া পরিয়ে তার সামনে আমাকে নিয়ে যায় পুলিশ। এক কথা, দুই কথায় আমার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করেন। জবাবে ভৈরব বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, ‘ও তাহলে আপনি জঙ্গি শফিকুরের এলাকার লোক।’ শফিকুর রহমান নামের একজন হরকাতুল জিহাদের লোক আছেন ওই এলাকায়। উনিও এখন জেলে আছেন। আমি বলেছি, শফিক সাহেবের সঙ্গে তো আমার কোনো যোগাযোগই নেই। তবে তাকে চিনি, ছোটবেলায় দেখেছি। এরপরই শুরু করে গালাগাল। খালেদা জিয়ার আঁচলের নিচে তোরা খুব আনন্দ পাস।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তোদের কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি দিলেন, এতগুলো মসজিদ বানালেন, আরও নানা কথা বলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন ওই ওসি। তিনি একপর্যায়ে আমাকে মারতে উঠে আসেন। আমাকে কোনো উত্তর দেওয়ার সুযোগই দেননি। একতরফা রাগ হয়ে কথা ও গালাগাল করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি আমাকে জুতা দিয়ে মারতে উদ্যত হন। তখন আমার হাতকড়া পরানো ছিল।

পরে পত্রিকায় পড়েছি সেই ওসি মনিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে এবং দুর্নীতি করে মোহাম্মদপুর বসিলা এলাকায় পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। তার বাড়ি সম্ভবত রাজবাড়ী। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তার চেয়ারে বসে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ও বিরোধীদলীয় নেতাকে যেভাবে গালাগাল করলেন, আলেম-ওলামাদের যে অকথ্য ভাষায় গালি দিলেন তা চিন্তা করা যায় না। আমার কোনো কথাই তারা শুনলেন না। একপর্যায়ের তার সামনে থেকে আমাকে নিয়ে যেতে বলেন। তার আচরণ আমাদের এতটা কষ্ট দিয়েছে যে, তা বলে শেষ করা যাবে না।

মাওলানা আতাউল্লাহ বলেন, ‘রমনায় রিমান্ডের এই তিন দিন অনেক কষ্টে গেছে। আমার মামলার আইও ছিলেন মাহফুজ, তিনিও আলেম-ওলামাদের নিয়ে নানা আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন, সরকারের পক্ষে যা যা বলার বলেছেন। নিরপেক্ষ থাকার কথা, অথচ পুলিশের আচরণ সবসময়ই ছিল সরকারদলীয় ক্যাডারদের মতো।’

কেরানীগঞ্জের জেলজীবনের বর্ণনা দিয়ে মাওলানা আতাউল্লাহ বলেন, ‘সেখানে থাকাকালে আসরের পর ৪০ মিনিটের জন্য শুধু বারান্দায় হাঁটাচলার সুযোগ দেওয়া হতো, কখনো আবার তাও দেওয়া হতো না। কারাগার থেকে যাতায়াতের সময় হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নেওয়া হয়। অনেক সময় জঙ্গি-দাগি আসামির মতো আলাদা গাড়িতে আমাদের আনা হতো।’

গ্রেপ্তারের সময় মাওলানা আতাউল্লাহর স্ত্রী ছিলেন অন্তঃসত্বা। তাই জেলখানায় খুব টেনশনে ছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো ধরনের যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয়নি তাকে। কারও সঙ্গে তাদের পরিবারের যোগাযোগের সুযোগও ছিল না। অথচ সাধারণ বন্দিদের টাকার বিনিময়ে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ রয়েছে।

একপর্যায়ে এক কারারক্ষীর মাধ্যমে তার মেয়ে হওয়ার এক দিন পর খবর পান তিনি। ওই কারাগারে ব্যাপক দুর্নীতি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, কারাগারে টাকা রাখা নিষেধ, কিন্তু সেখানে টাকার লেনদেন হয়। যাদের কাছে টাকা থাকে, তারা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। কিন্তু তাদের সেলের কাছে কোনো ফেরিওয়ালাও আসত না। এভাবে সব মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি।

মাওলানা আতাউল্লাহ বলেন, জেলখানার খাবার এমনিতেই ভালো না। তারপর আবার হয় দুর্নীতি। যে মান ও মেন্যুর খাবার দেওয়ার কথাÑ তা ঠিকমতো দেওয়া হয় না। এমন খাবার খেয়েই রোজা রাখতে হয়েছে জেলে। তিনি বলেন, কাশিমপুর কারাগারে থাকার সময় একে একে সাতটি মামলায় আমার জামিন হয়। জামিনের জন্য সপ্তাহে দু-এক দিন কোর্টে আসতে হয়। এ সময় বেশ কষ্ট হয়।

সব মামলায় জামিন শেষে জামিনে মুক্তির প্রস্তুতির সময় হঠাৎ আমাকে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের মামলায় সেখানে যেতে হবে। ২০২২ সালের মার্চে সেখানে কোর্টে উঠিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়।

অথচ তখন আমার সঙ্গে কোনো কাপড়চোপড় ছিল না। তবে সেখানে আগে থেকে থাকা মামুনুল হক ও মনির হোসাইন কাসেমী ছিলেন, তাদের রুমে থাকতে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সিদ্ধিরগঞ্জের চারটি মামলায় আমাকে জড়ানো হয় অথচ আমি কখনো সেখানে যাইনি। দীর্ঘ দুই মাস কারাগারে ছিলাম। পরে জেনেছি, আমার জামিন যাতে না হয় সে জন্য নিম্ন আদালত-সংশ্লিষ্টদের বলে দেওয়া হয়েছিল।

১৮ মাস জেলজীবনে ভয়াবহ কষ্টের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হন মাওলানা আতাউল্লাহ। তার অনুপস্থিতিতে স্ত্রীর প্রসূতি অস্ত্রোপচারসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হিমশিম খান সংশ্লিষ্টরা। এমনকি মাওলানা আমিনের হজ এজেন্সির একটি লাইসেন্স বাতিল এবং অফিস বন্ধসহ ব্যবসায়িকভাবেও তাকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এ ছাড়া মামলা চালাতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়েছে এই হেফাজত নেতার।


মূল রিপোর্ট : আমার দেশ