কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :
আগামী জাতীয় নির্বাচনে অন্তত ৩২টি সংসদীয় আসনে ঢুকে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমন তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। এসব আসনের মধ্যে রয়েছে সিলেট বিভাগেরও কয়েকটি। খবর যুগান্তর’র।
গণঅভ্যুত্থানে চব্বিশের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনাসহ কতিপয় নেতা বাংলাদেশের মানুষকে নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছে। হাসিনা দেশে ফিরে সবাইকে দেখে নেবেন- এমন হুমকিও প্রদান করা হচ্ছে বার বার। তিনি ভারতে বসে আত্মগোপনে থাকা তার দলের নেতাকর্মীদের ভয়েস কলে নানা নাশকতামূলক অপতৎপরতার নির্দেশনা দিচ্ছেন।
দেশের মানুষের কাছে ভীতিকর এই দলটি এবার নতুন করে চক্রান্ত শুরু করেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে চরম অস্থিতিশীলতা তৈরিসহ নির্বাচন বানচালের সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালাতে পারে।
দেশের অন্তত ৩২টি আসনে ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে তারা। সীমান্তবর্তী আসনগুলোতে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ভারত থেকে অবৈধভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে নির্বাচনে সহিংসতা চালাতে পারে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিতর্কিত ও বাধাগ্রস্ত করতে তারা সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ করে সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিতে পারে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ বিভিন্ন মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের উসকানি ও মদদ দিয়ে তাদের বসতবাড়ি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে ভোটের পরিবেশ নষ্ট করাসহ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালাতে পারে।
একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আওয়ামী চক্রান্তের এমন সব তথ্য। এরই মধ্যে প্রতিবেদনটি সরকারের উচ্চপর্যায়ে দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মী ভারতে অবস্থান নিয়েছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়- রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগ বর্তমানে গোপন বৈঠক করছে। এছাড়া অনলাইনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগসহ নানা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি দেওয়াসহ ধর্মীয় অপপ্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশে বাধাগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)-এর মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে ডিপ ফেক ভিডিও, মিথ্যা ভাষণ বা নকল বার্তা তৈরি করে অসত্য তথ্য প্রচার করতে পারে।
গোয়েন্দারা জানান- যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও পাবনা জেলার ১০টি আসনে চরমপন্থিদের তৎপরতা আছে। পার্বত্য জেলার তিন আসনে রয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, স্বার্থান্বেষী মহল ও আওয়ামী লীগ এসব চরমপন্থি গ্রুপ এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে আওয়ামী লীগ।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে ৫ হাজার ৭৬৩টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪২৩টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এখনো উদ্ধার হয়নি এক হাজার ৩৪০টি অস্ত্র। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন ধরনের ১০ হাজার ৫০৬টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে ৬৫৭টি অস্ত্র এখনো জমা পড়েনি। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অস্ত্রের একটি বড় অংশ সন্ত্রাসী, ডাকাত, ছিনতাইকারী, মাদককারবারি এবং কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে গেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এসব অস্ত্র ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী- জুলাই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া এবং থানা ঘেরাওসহ নানা কারণে পুলিশের মধ্যে এখনো ভীতি কাজ করছে। পুলিশের মনোবল দ্রুত চাঙা ও সক্রিয় করা না গেলে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ৫ আগস্টের পর যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিন পেয়েছে তারা চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী মহল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চালাতে পারে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, মাগুরা, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে শক্ত। দলটির কার্যক্রম স্থগিত হওয়ায় নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম। এক্ষেত্রে ওইসব এলাকাসহ সারা দেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে তারা। পাশাপাশি ভোটারদের কেন্দে যেতে বাধা দেওয়া, ভয়ভীতি দেখানো এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালানো হতে পারে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী- দেশে মোট সীমান্তবর্তী সংসদীয় আসন সংখ্যা ৬২টি। এগুলোর মধ্যে ৩২টি আসনে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার শতকরা ১০ ভাগের বেশি। ১০টি নির্বাচনি আসনে চরমপন্থি ও তিনটি আসনে সশস্ত্র গোষ্ঠীর অপতৎপরতা আছে। ২৬টি আসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু) ভোটের হার ২০ ভাগের বেশি। ৭৮টি আসনে সংখ্যালঘু ভোট ৫০ হাজারের বেশি। এসব ভোট আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসাবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বিরত থাকলে এসব ভোটার ভোট প্রদানে বিরত থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে অন্যান্য দলের প্রার্থীরা তাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে চাপাচাপি করলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভোটের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হতে পারে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১১ মাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ২ হাজার ৬৮৫টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ২৫৬টি। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৫৬টি। মোট ঘটনার ৭৬ ভাগই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। মাত্র ২ ভাগ ঘটেছে সাম্প্রদায়িক কারণে। বাকিগুলো ঘটেছে অন্যান্য কারণে।
যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে তাদের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে কমবেশি অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার এবং পদ-পদবিসহ নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে এসব কোন্দল তৈরি হয়েছে। এতে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির অন্তর্কোন্দলে শতাধিক নিহত ও দুই হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। বিএনপি বনাম অন্যান্য দলে কোন্দলে নিহত হয়েছেন ২১ জন এবং আহত হয়েছেন ৪২১ জন। রাজনৈতিক কোন্দল থামাতে না পারলে নির্বাচনকালীন সহিংসতা ও হতাহত অনেক বাড়বে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বট ও ফেক আইডি ব্যবহার করে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কৃত্রিমভাবে বেশি দেখানোর মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করার আশঙ্কা আছে জানিয়ে এতে বলা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আধিপত্য বিস্তার, ভোটারদের হুমকি দেওয়া, প্রচার-প্রচারণায় বাধা দান, এজেন্ট বের করে দেওয়া, জাল ভোট দেওয়া, অবৈধ অর্থের ব্যবহার ইত্যাদি কারণে প্রার্থীর কর্মী-সমর্থদের মধ্যে সংঘাত, সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।
পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) বলেন- সব ধরনের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই আমরা কাজ করছি। তফসিল ঘোষণার পরপর আমাদের তৎপরতা আরও বেড়ে যাবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার হবে। নির্বাচনকালীন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত।