জুলাই শহিদ হাফেজ জসিম ও তাঁর প্রিয় বিদ্যাপীঠ

নাফিস অলি >>

নদীমাতৃক রূপসী বাংলার রূপের আধার বরিশাল জেলার পশ্চিমের উপজেলা বানারীপাড়ার এক নিভৃত গ্রাম সলিয়াবাকপুর। চোখজুড়ানো সবুজ আর গভীর মায়ায় ঘেরা এর প্রকৃতি। অদূরে কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলে নির্মল সন্ধ্যানদী। ১৯৮৯ সালের ২৮ নভেম্বর এ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন। বাড়ির পাশে দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম হোসাইনিয়া কওমিয়া কেরাতিয়া মাদরাসা। শৈশবের ছুটোছুটি কাদামাখা রঙ্গিন দিনগুলো কেটেছে এই মাদরাসার মাঠে। পরবর্তীতে এখানে তার অক্ষরজ্ঞানের হাতেখড়ি হয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান ইলমে ওহীর পাঠ গ্রহণ করেন। পবিত্র কুরআন হিফজ সম্পন্ন করে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রথমে বরিশাল এবং পরবর্তীতে ঢাকা গমন করেন।

সন্ধ্যাপাড়ের নির্মল প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠার কালে শৈশব-তারুণ্য তাকে যে উপলব্ধিগুলোর সাথে পরিচয় করায় - যা তিনি লালন করেছেন আজীবন — তার অন্যতম এই মাদরাসা। এর রয়েছে দীর্ঘ প্রায় আট দশকের ঐতিহ্য ও আনন্দ-বিষাদ মোড়া দীর্ঘ ইতিহাস। এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের ন্যায় তিনিও প্রভাবিত হয়েছিলেন মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, দক্ষিণবঙ্গের বিশিষ্ট বুযুর্গ ও আধ্যাত্মিক রাহবার, মহান সংস্কারক শাহ সুফি আরেফ আলী মুনশী রহ (মৃত্যু: ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ) এর জীবন ও কর্ম দ্বারা।

জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকার উত্তরায় একটি কার রিপেয়ারিং ওয়ার্কশপে ম্যানেজারের সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। পড়াশোনা ও কর্মজীবন মিলিয়ে ঢাকায় ছিলেন প্রায় ১৫ বছর। গ্রাম ছেড়ে দূরে অবস্থান করলেও সর্বক্ষণ তার চিন্তারা ছুটে বেড়াত শৈশবের মাঠ আর মাদরাসার বারান্দাজুড়ে। মাদরাসা নিয়ে তার চিন্তার অন্ত ছিল না। কোথায় কার কী সমস্যা হচ্ছে, কোথায় কী প্রয়োজন—নিত্যদিন এসবই ছিল তার ভাবনায়। ঢাকা থেকে এলে আগে মাদরাসার খোঁজখবর নিয়ে তবে বাড়িতে যেতেন। প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির জন্য তার হৃদয় উজাড় করা আবেগ সম্পর্কে এখানকার স্থানীয়জন মাত্রই জেনে থাকবেন। বিশেষত গত ৪-৫ বছরে তার প্রচেষ্টা ছিল উপমাতুল্য। তিনি এর সোনালী অতীতের গল্প জানতেন। দেওবন্দী আদর্শ ও চেতনা ধারণ করে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ একদা শিক্ষাঙ্গণের ভূমিকার ঊর্ধ্বে গিয়ে কিভাবে সর্বসাধারণের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেরণার বাতিঘর হয়ে উঠেছিল তিনি তা জানতেন। কিভাবে মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল তাও অজানা ছিল না তার। তিনি দেখেছেন আজ সেই ঐতিহ্যাবাহী প্রতিষ্ঠান তার জৌলুস হারিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে ক্লান্ত। জসিম উদ্দিন দূরে থাকতে পারেন নি। নিজের সমস্ত কিছু উজাড় করে মাদরাসার সংস্কারে ব্রত হয়েছিলেন। সে এক দুর্গম জার্নি। তবু এ সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন সকাল, দুপুর, রাত-দিন। ক্লান্তিহীন।

প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে আকাশসম স্বপ্ন ছিল তার। একান্ত প্রচেষ্টায় জেগে উঠেছিল এই প্রাঙ্গণ। নিদ্রা টুটে গিয়েছিল ঘুমন্তের। ফুল ফুটেছিল সবুজ পাতার ডালে ডালে। ক্ষণিকের জন্য মৌমাছির গুঞ্জনে মুখর হয়েছিল চারপাশ। অতঃপর এলো জুলাই। ইতিহাসের রক্তিম অধ্যায় জুলাই। গণমানুষের মুক্তির পয়গাম জুলাই।

হাফেজ জসিম উদ্দিনরা অদম্য ক্লান্তিহীন। তাদের জীবনজুড়েই সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে কখনো থাকে পরিবার-সমাজ, কখনো শৈশবের প্রিয় বিদ্যাপীঠ, আবার কখনো প্রিয় স্বদেশ। দেশের প্রয়োজনে, দশের প্রয়োজনে সবার আগে জসিম উদ্দিনরা।

১৮ জুলাই ২০২৪, উত্তরা ৫নং সেক্টর। অসংখ্য দৃপ্ত পায়ের সাথে যুক্ত হয় আরও দুটি সাহসী পা। ফ্যাসিস্ট শাসকের রক্তচক্ষু টলাতে পারেনি যে পা। স্লোগানে স্লোগানে গর্জে ওঠে জনতা। হঠাৎ পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি। পুলিশের নির্মম বুলেটের আঘাতে শহিদ হন হাফেজ জসিম উদ্দিন। জুলাইয়ের প্রথম আলেম শহিদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয় শাসক। তবু দুর্বার তারুণ্যের মাথা নোয়াবার নয়। পরেরদিন ১৯ জুলাই শেষবারের মতো হাফেজ জসিম মাদরাসা মাঠে আসেন। নিথর নিষ্প্রাণ। মাদরাসা মাঠে জানাজা শেষে পিতার পাশে সমাহিত হন পারিবারিক কবরস্থানে।

সেদিন যে রক্তপিচ্ছিল পথ ধরে বিজয় এসেছিল তাতে জীবন দেওয়া প্রত্যেক শহিদের গল্প হৃদয়স্পর্শী, হারানোর শূন্যতা অপূরণীয়। তথাপি শহিদ জসিম উদ্দিনের প্রস্থান যেন আকাশসম স্বপ্ন ও দুর্বার সংগ্রামের প্রস্থান। যাতে নিভে গেছে আশার সূর্য। যার আলোয় জেগে উঠেছিল মৃত উপত্যকা। জেগে উঠেছিল একটি আদর্শ, একটি প্রতিষ্ঠান। শহিদ জসিম উদ্দিনের অবুঝ দুই শিশুসন্তান আজও পিতার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। অপেক্ষায় তার প্রিয় ক্যাম্পাস। যেখানে তার অনুপস্থিতির শূন্যতা ভয়ানক হয়ে উঠছে ক্রমাগত।


লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]