‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্পের শুরুতেই অনিয়ম

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

প্রাথমিক স্তরের শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ এবং তাদের পুষ্টিমান বৃদ্ধির জন্য আবারও ‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এজন্য দুই হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি গত জুলাইয়ে চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের তিন মাস পার হলেও এখনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।

মূল কারণ, টেন্ডার (দরপত্র) কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়া। ২৫ আগস্ট টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এখন পর্যন্ত দুটি দরপত্র চূড়ান্ত হলেও বাকিগুলোর মূল্যায়ন (ইভ্যালুয়েশন) প্রক্রিয়া চলছে।

এদিকে এই টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে নিয়মবহির্ভূতভাবে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়াদেশ দেওয়া হচ্ছে। এতে শুধু ‘বিস্কুট’ কেনার ক্ষেত্রেই সরকারের ২০ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য সরবরাহ করা খাবারের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এছাড়া প্রকল্পের কাজ দেরিতে শুরু করায় দেশের ৮টি বিভাগের ১৫০টি উপজেলার প্রায় ৩১ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থী তাদের নির্ধারিত ‘মিড ডে মিল’ বা দুপুরের পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের পুষ্টি, মনোযোগ ও শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, স্কুল ফিডিং প্রকল্পটি সময়মতো ও স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়ন না হলে এর মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি বাড়ানো, ঝরে পড়া রোধ করা, অপুষ্টিজনিত সমস্যা হ্রাস ও শিক্ষায় মনোযোগ ধরে রাখার মতো কার্যক্রম ব্যাহত হবে। একই সঙ্গে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনও থেমে যাবে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের যথাযথ তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুব জরুরি।

এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ‘মিড ডে মিল’ টেন্ডার (দরপত্র) প্রক্রিয়া এখনো চলমান। তবে দরপত্রে অনিয়মের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এটা ইভ্যালুয়েশন কমিটি কাজ করছে। তারা বলতে পারবে।

জানতে চাইলে স্কুল ফিডিং প্রকল্পের পরিচালক ও যুগ্মসচিব মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম হয়নি। টেন্ডারে যেসব প্রতিষ্ঠান লোয়েস্ট হয়েছে, তারা টেকনিক্যালি নন-রেসপন্সিভ। তাই তারা বাদ পড়েছে। স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম আগামী মাসের শেষদিকে চালু করা হবে। ইতোমধ্যে বিস্কুট ও দুধ-এই দুটি টেন্ডারের কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো মূল্যায়ন (ইভ্যালুয়েশন) চলছে।

সূত্রমতে, ‘স্কুল ফিডিং’ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে স্কুল চলাকালে শিক্ষার্থীদের মাঝে পুষ্টিসমৃদ্ধ ফর্টিফাইড বিস্কুট, ইউএইটটি মিল্ক, বনরুটি, সিদ্ধ ডিম, কলা ও স্থানীয় মৌসুমি ফল প্রদান করা। রোববার বনরুটি ও সিদ্ধ ডিম, সোমবার বনরুটি ও ইউএইচটি দুধ, মঙ্গলবার বনরুটি ও সিদ্ধ ডিম, বুধবার ফর্টিফাইড বিস্কুট ও কলা বা স্থানীয় মৌসুমি ফল এবং বৃহস্পতিবার বনরুটি ও সিদ্ধ ডিম দেওয়া হবে।

প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের মাঝে পুষ্টিসমৃদ্ধ ফর্টিফাইড বিস্কুট সরবরাহের টেন্ডার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কিশোয়ান স্ন্যাকস লিমিটেড, রেসকো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফেক্টরি, মাসাফি ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, প্রাণ ডেইরি লিমিটেড, এএএস এন্টারপ্রাইজ, রেসকো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি, ব্লসম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, ইউনাইসা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নিউ অলিম্পিয়া বিস্কুট প্রাইভেট লিমিটেডসহ কয়েকটি কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নেয়। এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের জন্য সর্বনিম্ন দরদাতা (৪০ কোটি ৬৪ লাখ ২৪ হাজার ৮৩৮ টাকা) মাসাফি ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ইন্ডাস্ট্রিজ। এরপর ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা (৪৫ কোটি ৪০ লাখ ৫৬ হাজার ৫৪০ টাকা) ব্লসম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, তৃতীয় (৪৬ কোটি ২৩ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৯ টাকা) কিশোয়ান স্ন্যাকস, চতুর্থ (৪৬ কোটি ৬৬ লাখ ১৩ হাজার ৭২৯ টাকা) প্রাণ ডেইরি লিমিটেড এবং ৫ম দরদাতা (৪৮ কোটি ৩৭ লাখ ৬৫ হাজার ৭০৭ টাকা) ইউনাইসা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে প্রায় একইরকম দর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অবস্থায় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে স্কুল ফিডিংয়ের কাজ পাওয়ার কথা মাসাফি ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ইন্ডাস্ট্রিজের। কিন্তু চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রাণ ডেইরিকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সব বিভাগ মিলিয়ে সরকারকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে ২০ কোটি ২ লাখ টাকা।

এ প্রসঙ্গে সর্বনিম্ন দরদাতা মাসাফি ব্র্যান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল এইচ চৌধুরী বলেন, আমরা সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরও বাদ পড়েছি। অথচ টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর এক মাস পর কার্যাদেশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের কেন বাদ দেওয়া হয়েছে বা কোনো ঘাটতি ছিল কিনা কিছুই জানানো হয়নি। অথচ এই প্রকল্পের সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছি।

একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ব্লসম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের এজিএম সাইদুর রহমান বলেন, সাধারণত সর্বনিম্ন দরদাতা কাজ না পেলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সর্বনিম্ন প্রতিষ্ঠানদের মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু আমরা সেই ধরনের কোনো রেসপন্স পাইনি। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন সমস্যা হয়েছে।

২০০১ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে প্রথম স্কুল ফিডিং কর্মসূচির সূচনা হয়ে তা ২০১০ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। এরপর ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু ছিল। ২০২২ থেকে ২০২৪ এ কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

(মূল রিপোর্ট : যুগান্তর)