নূর আহমাদ >>
বিশ্ব মুসলমানের মিলনমেলা হজ শেষ হয়েছে। হাজিরা এখন বাড়ির পথে রওয়ানা করছেন। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদ চুমু, আরাফায় অবস্থান আর সাফা-মারওয়ায় সায়ীর মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন হলেও হজের শিক্ষা ধরে রাখতে হয় জীবনজুড়ে। হজে যেভাবে আল্লাহর কাছে পূর্ণ আনুগত্য দেখানো হয়েছে, হজপরবর্তী জীবনে সে আনুগত্য বজায় রাখলেই বুঝতে হবে কষ্টের হজ কবুল হয়েছে।
হজপরবর্তী জীবনে হাজিদের করণীয় সম্পর্কে বিশেষভাবে বলেছেন দেশবরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ ও কুরআন গবেষক মাওলানা শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন। তিনি জামালী তালিমুল কুরআন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ২৪ ঘণ্টায় কুরআন শিক্ষা মেথডের আবিষ্কারক।
শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন বলেছেন- ইসলাম উদযাপনকেন্দ্রিক ও অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও কুরবানিসহ ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের বাহ্যিক নিয়ম-বিধান ও আচরণশৈলী রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি ইবাদত ও আমলের অন্তর্নিহিত দর্শনও রয়েছে। বিত্তবান, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ, লাখ মানুষ হজ পালন করেন। পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, হজের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নির্দিষ্ট মাসে হজ অনুষ্ঠিত হয়। এ মাসগুলোতে যার ওপর হজ ফরজ হয়, সে যেন হজে গিয়ে স্ত্রী সম্ভোগ, অনাচার ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়। তোমরা যেসব সৎ কাজ করো, আল্লাহ তা জানেন। আর পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করো, নিশ্চয়ই তাকওয়া বা আল্লাহভীতিই শ্রেষ্ঠ পাথেয়’। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৭)। হাজিরা হজের শিরকমুক্ত নির্ভেজাল তাওহিদের ঘোষণা দেন বারবার। তাই বাকি জীবন শিরক থেকে দূরে থাকা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর ছাড়া কারও হুকুম না মানার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সব ধরনের অনাচার ও তাগুতকে অস্বীকার করার মাধ্যমে মর্দে মুমিন হওয়ার প্রশিক্ষণই হজ। তাই হজ থেকে ফেরার পর আল্লাহর হুকুমের বাইরে একটি কদমও ফেলার সুযোগ নেই। সব সময় মনে রাখতে হবে, ইহরামের কাপড় গা থেকে খুলে ফেললেও ইহরামের ঘ্রাণ যেন জীবন থেকে খসে না পড়ে। তাহলে কষ্টের হজ বৃথা যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি আরও বলেন- যাদের হজ কবুল হয়, তাদের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যত্নবান হয়। হজ করার পর যার জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। পির-মাশায়েখরা বলেন, ‘নেক কাজ কবুল হওয়ার আলামত হলো, পরবর্তী জীবনেও নেক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। আর অভিশপ্ত পাপী জীবনের আলামত হলো, অব্যাহতভাবে পাপ কাজ করে যাওয়া।’ বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজব্রত পালন করেন। এদের মধ্যে কয়জনই বা হাদিসে ঘোষিত নিষ্পাপ হয়ে ফিরতে পারেন? দেশে বছরে বছরে হাজির সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু সমাজে অনাচার কি কমছে? দেশ ও সমাজ এসব হাজিদের মাধ্যমে কতটুকু উপকৃত হচ্ছে। তারা কি যথাযথভাবে পরিশুদ্ধ হয়ে সমাজের হজের নুর ছড়িয়ে দিতে পারছেন? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য! আমাদের অনেকের হজ-ওমরাহ হানিমুন, শপিং, পর্যটন ও প্রমোদভ্রমণ হয়ে পড়েছে। ত্রুটিপূর্ণ নিয়তের কারণে মক্কা-মদিনার জিয়ারত ও পবিত্র সফর-আমাদের শুভবুদ্ধি ও তাকওয়া জাগ্রত করতে পারছে না। হজ কবুল হওয়ার আলামত হলো, ইহরামের সুবাস কখনো জীবন থেকে হারিয়ে যাবে না। দুনিয়ার লোভ, লালসা, অশ্লীলতা, মোহ তাকে প্রভাবিত করবে না। নিখাদ সোনার মানুষ হয়ে সে দুনিয়ায় জীবনযাপন করবে। তার কাজে কেউ কষ্ট পাবে না। সে কারও সম্পদ অন্যায়ভাবে লুট করবে না। চাঁদাবাজি, রাহাজানি, নারীর শ্লীতহানির কথা তাকে দিয়ে কল্পনাও করা যাবে না। অন্যদিকে সে হবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাবন্দি। হবে কুরআনের কর্মী। কুরআন বাস্তবায়নের মহৎ লক্ষ্যই হবে তার জীবনের ভিশন ও মিশন।
প্রখ্যাত এই আলেম বলেন- হজ থেকে ফিরে এসে নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। হজরত কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে নফল নামাজ আদায় করতেন।’ (বুখারি শরিফ।) হজ থেকে ফিরে শুকরিয়াস্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। ইসলামি ফিকহের পরিভাষায় একে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়। জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘রাসূল (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবিরা তা থেকে আহার করেছেন।’ (বুখারি শরিফ।) তবে অহংকার, লোক দেখানো, রাজনৈতিক প্রচারণা কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্যে এমন দাওয়াতের ব্যবস্থা করা শরিয়ত অনুমোদন করে না।’ (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া, ৭ম খণ্ড, ১৮৫ পৃষ্ঠা।) হজ থেকে দেশে ফেরার পর ঘরে পৌঁছে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখন দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে।’ (মুসনাদে বাজ্জার।)
বিদগ্ধ আলেম জামাল উদ্দীন আরও বলেন- যারা হজ করে আসছেন, তাদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু রাজনৈতিক প্রচারণার উদ্দেশ্যে হাজিকে ফুলের মালা দেওয়া, তার জন্য শরিয়তবিরোধী স্লোগান দেওয়া, যানজট সৃষ্টি করে মিছিল করা শরিয়তের অপছন্দনীয়। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। (আপকে মাসায়েল আওর উনকি হল, ১ম খণ্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা।) হজে গেলে হজযাত্রীরা জমজমের পানি নিয়ে আসেন। জমজমের পানি নিয়ে এসে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। অসুস্থ রোগীদের গায়ে এ পানি ছিটিয়ে দেওয়া বা প্রয়োজনে গোসল দেওয়াও জায়েজ। (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ, ৩০৩ পৃষ্ঠা।) আম্মাজান আয়েশা (রা.) হজ থেকে ফেরার সময় জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রাসূল (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস ১১৫।)
হজযাত্রীদের হাদিয়া-উপহার বিষয়ে তিনি বলে- আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-পড়শী ও যে কাউকে হাদিয়া-তোহফা দেওয়া সুন্নত। কিন্তু মনের আগ্রহ ছাড়া সামাজিক বা পারিবারিক চাপে পড়ে নিয়ম রক্ষার উপহার দেওয়াকে আমরা নিরুৎসাহিত করি। শুধু প্রথা পালনের জন্য কোনো কাজ করা শরিয়তসম্মত নয়। কেউ হজে যাওয়ার সময় তাকে কিছু হাদিয়া দেওয়া এবং হজ থেকে আসার পর হাজি নিজে তার আত্মীয়-বন্ধুদের জমজমের পানি, খেজুর, তসবিহ, জায়নামাজ হাদিয়া দেওয়া খুবই ভালো কাজ। কিন্তু এটি যদি বাধ্যতামূলক করা হয়, এসব হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া না হলে মনোমালিন্য কিংবা সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে ওলামারা এ ধরনের লোক দেখানো প্রথা পালনে নিষেধ করেন। ফতোয়ার কিতাবে লেখা আছে, ‘হাজিদের উপহার দেওয়া ও তাদের থেকে হাদিয়া নেওয়া বর্তমানে এক ধরনের প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এটা নামের জন্য বা চক্ষুলজ্জার কারণেও দেওয়া হয়ে থাকে। তাই এসব কাজ বর্জন করা উচিত।’ (আপকে মাসায়েল, ৪র্থ খণ্ড, ১৬১ পৃষ্ঠা।)
নামের আগে ‘হাজি’ বা ‘আলহাজ’ লকব দেওয়া সম্পর্কে শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন বলেন- মানুষ ইবাদত-বন্দেগি করে একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। কেউ নিয়মিত ঠিকভাবে নামাজ পড়লে তাকে কেউ ‘নামাজি সাহেব’ বলে না অথবা এ ধরনের কোনো উপাধি ব্যবহার করা হয় না। তেমনি হজ করলেই ‘হাজি সাহেব’ বলা নিয়ম নয়। ‘হাজি সাহেব’ বা ‘আলহাজ’ উপাধি পাওয়ার নিয়তে হজ পালন করা অবৈধ। তবে মানুষজন যদি সম্মানার্থে ‘হাজি সাহেব’ বলে ডাকেন, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের নামের সঙ্গে ‘হাজি’ বা ‘আলহাজ’ ব্যবহার করা অসংগত। পাশাপাশি কেউ এ বিশেষণটি উল্লেখ না করলে, মনক্ষুণ্ন হওয়াও গর্হিত। (মুকাম্মাল মুদাল্লাল মাসায়েলে হজ ও ওমরাহ, ৩২১ পৃষ্ঠা।)