সাত শ বছরের অপপ্রথা ভেঙে ইতিহাস গড়লো সিলেটের ‘তাওহিদি কাফেলা’

কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :

রাত পোহালেই শুরু হবে হযরত শাহজালাল রাহ. দরগাহে বার্ষিক ওরস। প্রথা অনুযায়ী- ১৯ ও ২০ জিলকদ (১৮ ও ১৯ মে- রবি ও সোমবার) এই দুদিন ওরস অনুষ্ঠিত হবে। এবারের ওরসটি ৭০৬তম। 

তবে এবারে শাহজালাল মাজারের ওরস হচ্ছে অনেকটা ব্যতিক্রম। ৭০০ বছরের শিরক-বিদাআতমূলক অপসংস্কৃতি ভেঙে এবারই প্রথম গান-বাজনা ও মদ-গাঁজাবিহীন ওরস পালনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সিলেটের আলেম-সমাজের শক্তিশালী ভূমিকায়।

চব্বিশের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সিলেটে গঠিত হয় ‘হযরত শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলা’। সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছেন সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি আলেম, বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিম-পরিচালক ও সিনিয়র শিক্ষকরা। তবে মুখ্য সংগঠকের ভূমিকা পালন করছেন কাফেলার সদস্যসচিব, একসময়ের নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবিবুর রহমান রাহ.-এর হাতেগড়া বিপ্লবী আলেম, জামিয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার-এর সিনিয়র মুহাদ্দিস ও লেখক-কলামিস্ট মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ।

প্রতিষ্ঠাকালে সিলেটবাসীর প্রতি ‘শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলা’র বার্তা ছিলো- শাহজালাল-শাহপরাণ রাহ. সিলেটে এসেছিলেন মহান আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে। এ অঞ্চল থেকে শিরক-বিদআতসহ সকল প্রকার পাপাচার দূর করে সুন্দর-সুস্থ্য সমাজ গঠন করতে। কিন্তু তাঁদের ওফাতের পর তাঁদেরই মাজারকে একটি গোষ্ঠী বানিয়ে দিয়েছে শিরক-বিদআতসহ সকল অনৈতিক-অসামাজিক কাজের কেন্দ্রস্থল। ‘শাহজালাল  তাওহিদি কাফেলা’ এবার এসব অপকর্ম ঠেকাতে চায়। তাই প্রশাসন ও সিলেটের সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শাহজালাল-শাহপরাণসহ সকল মাজারের পবিত্রতা রক্ষার মিশনে নেমেছে এই কাফেলা।

প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনটি বেশ সাড়া ফেলে সিলেটে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন সিলেটের রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন অঙ্গনের নেতৃবৃন্দ। সহযোগিতা করে প্রশাসনও। যার ফলে গত বছর শাহপরাণ মাজারে অনুষ্ঠিত ওরসে ছিলো না মদ-গাঁজার আসর। বাজানো হয়নি বাদ্যযন্ত্র। এ ক্ষেত্রে শাহপরাণ মাজার কমিটিও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। 

এদিকে, শাহজালাল রাহ. এর মাজারের ওরসের বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে কাজ করতে থাকে ‘হযরত শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলা’। কাফেলার নেতৃবৃন্দ জেলা ও পুলিশ প্রশাসন এবং মাজার এলাকার বিভিন্ন পঞ্চায়েত কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে মতিবিনিময় করেন। প্রদান করা হয় স্মারকলিপি। তাদের দাবি ছিলো- এবারের ওরস হবে সম্পূর্ণ শিরক-বিদাআত ও অনৈসলামিক-অসামাজিক কর্মকাণ্ডমুক্ত। এছাড়া মাজারে প্রতি বৃহস্পতিবার ভক্তবৃন্দের জমায়েত এবং ওরসের আগে লাকড়ি তোড়া উৎসবেও হবে না এসব কাজ।

‘শাহজালাল তাওহিদি কাফেলা’র জোর দাবির মুখে প্রতি বৃহস্পতিবারের জমায়েতে অনেকটাই বন্ধ হয়েছে অনৈসলামিক-অসামাজিক কাজ। ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত লাকড়ি তোড়া উৎসবেও হয়নি গান-বাজনা।

সর্বশেষ ‘শাহজালাল তাওহিদি কাফেলা’র দাবির প্রেক্ষিতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার মো. রেজাউল করিম (পিপিএম- সেবা) মাজার কর্তৃপক্ষ ও কাফেলার নেতৃবৃন্দ নিয়ে বৈঠকে বসেন। ৮ মে দুপুরে এসএমপি কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে শাহজালাল মাজার কমিটি, শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলা ও সিলেট মহানগর কওমি মাদরাসা ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও প্রশাসনিক দপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিতে ছিলেন। এসময় মাজারের অন্যতম খাদেম এ এম এন জামান চৌধুরী ওরসের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন- অন্যান্যবারের মতো এবার গান-বাজনা হবে না, বসবে না মদ-গাঁজার আসর। এবারের ওরস শিরক-বিদাআতমুক্ত পরিবেশ রাখার চেষ্টা করা হবে।

তার বক্তব্যে পর ওরসে অনৈসলামিক-অসামাজিক কাজ বন্ধে শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলার পক্ষ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবগুলো যৌক্তিক এবং সুন্দর বলে স্বীকার করেন মাজার কমিটি এবং এগুলো বাস্তবায়নে তারা সহযোগিতা করবেন বলেও আশ্বাস প্রদান করেন  নেতৃবৃন্দ।

পরে সবার সম্মতিক্রমে এসএমপি কমিশনার ‌‘ওরস উদযাপনে শৃঙ্খলা রক্ষা তদারকি কমিটি’ গঠন করে দেন। এ কমিটির প্রধান এসএমপি কমিশনার। কমিটিতে রয়েছেন- সেনাবাহিনী, র‍‍্যাব-৯, শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলা, মাজার কমিটি, শাহজালাল মসজিদ কমিটি, দরগাহ মাদরাসা কমিটি, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, জেলা সিভিল সার্জন, সিলেট জেলা প্রেসক্লাব, সিলেট প্রেসক্লাব ও মহানগর কওমি মাদরাসা ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিবৃন্দ।

এদিকে, শুক্রবার (১৬ মে) এসএমপি কমিশনার মাজার প্রাঙ্গনে প্রেস ব্রিফিং করে বলেন- এবারের শাহজালাল রাহ. মাজারের ওরস আরও সুশৃঙ্খল ও পবিত্র পরিবেশে সম্পন্নের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন, মাজার কর্তৃপক্ষ, আলেম-উলামা ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত তদারকি কমিটি ওরস চলাকালীন সর্বদা মনিটরিং করবে। ওরসকালীন মাজারের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে এবার ভক্তবৃন্দের প্রতি বলা হচ্ছে- সবাই যেন মাজারে সিজদা প্রদানসহ সকল শিরকি ও বিদাআতি কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন। নারীরা পর্দার সঙ্গে অবস্থান করেন। কেউ যেন মদ-গাঁজার আসর না বসান। এসব বিষয় তদারকটি কমিটি সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখবে। এছাড়া পুলিশের বিভিন্ন টিম মাজার প্রাঙ্গনে সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থানে থাকবে। ঠেকাবে সব অসামাজিক-অনৈসলামিক ও বিশৃঙ্খল কাজ। মাজার প্রাঙ্গনে চুরি-ছিনতাই ও প্রতরণামুলক কর্মকাণ্ড রোধেও কাজ করবে পুলিশ। সাদা পোশাকে অবস্থান করবে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার বলেন- নামাজ ব্যতীত কেউ যাতে কোথাও সিজদা না দিতে পারেন সেজন্য উপরে শাহজালাল রাহ. এর মাজারের সামনে ব্যানার টানানো হয়েছে। তবে মাজার এলাকার বিভিন্ন স্থানে এভাবে আরও ব্যানার টানানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে মাজার কর্তৃপক্ষকে বলা হবে।

অপরদিকে, ওরস চালাকালীন এবং এর আগে থেকে নানা কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে ‘শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলা’। এর ধারাবাহিকতায় ওরসের আগের দিন শনিবার (১৭ মে) বিকালে দরগাহ মাদরাসায় খতমে কুরআনের আয়োজন এবং পরে বিশেষ মুনাজাত পরিচালনা করা হয়। এছাড়া রয়েছে নাশিদ অনুষ্ঠানের আয়োজন।

কাফেলার নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন- ওরস চলাকালীন শিরক-বিদাআতের ভয়ানক পরিণতি এবং পবিত্রতা রক্ষা করে কবর জিয়াত ও ইবাদাতের বর্ণনাসংবলি প্রচারপত্র শাহজালাল রাহ.-এর ভ্ক্তবৃন্দের মাঝে বিতরণ করা হবে।

‘হযরত শাহজালাল রাহ. তাওহিদি কাফেলা’র সদস্যসচিব মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ কওমি কণ্ঠকে বলেন- সিলেটবাসীকে এবার একটি ব্যতিক্রমী ও পবিত্র ওরস উপহার দিতে আমরা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের প্রশসংনীয় সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। এছাড়া মাজার কর্তৃপক্ষও আন্তরিক রয়েছেন। যে উদ্দেশ্যে কাফেলাটি গঠিত হয়েছে- আল্লাহ যেন সর্বদা খালিসভাবে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করার তাওফিক দান করেন এবং আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াসকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন কবুল করেন।